সুপ্রিয় দর্শকবৃন্দ আজকে আমি আপনাদের জানাবো গাজর খাওয়ার দশটি উপকারিতা অপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে। ফলমূলের মধ্যে গাজরের উপকারিতা অনেক বেশি। গাজরের উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ বেশি থাকায় একে সুপারফুটোয় বলা হয়ে থাকে। গাজর সালাত হিসেবে আমরা বেশি ব্যবহার করে থাকি।
এই গাজর পোলাও খিচুড়ির সাথে রান্না করা ছাড়াও গাজরের আচার ও চাটনি হালুয়া সুস্বাদু ও পুষ্টিতে ভরপুর খাবার হিসেবে খাওয়া হয়। গাজরের মধ্যে যে ভিটামিন রয়েছে তা আমাদের শরীরকে সুস্থ সবল রাখতে অনেক সহায়তা করে। গাজার বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন থাকায় গাজরের উপকারিতা অনেক বেশি। তবে আমরা অনেকেই গাজর খেলেও এর উপকারিতা ও ভিটামিন সম্পর্কে জানি না।
তবে চলুন জেনে নেওয়া যাক গাজরের সম্পর্কে কিছু তথ্য। গাজরের বৈজ্ঞানিক নাম হল ডাকাস ক্যারোটা। এখন গাজরের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে পড়ি ১০০ গ্রাম কাঁচা গাজরে ৯ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট থাকে। চিনি ছয় গ্রাম, ডায়েটারি ফাইবার তিন গ্রাম, ফ্যাট ০.২ গ্রাম, প্রোটিন ২ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৩৩ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ১৮ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৩৬ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ২৪০ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ২.৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি ০.০৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি টু ২০.০৬ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি থ্রি ৩৩.২ মিলিগ্রাম ও ভিটামিন বি ফোর ৬২.০১ মিলিগ্রাম এবং ভিটামিন সি ৭ মিলিগ্রাম থাকে।
গাজরের অসাধারণ স্বাস্থ্য ও পুষ্টিগুণ
ছোটবেলা থেকে গাজর নামটির সাথে আমরা অনেক বেশি পরিচিত। কারণ হলো আমাদের মা দাদীরা ছোটবেলা থেকেই আমাদের গাজর খাইয়েছেন এবং এখনো পর্যন্ত আমরা খেয়ে আসছি। গাজর বিভিন্ন খাবারের সঙ্গে ব্যবহার করা হয় কিন্তু এতে আছে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টিগুণ।
দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সক্ষম এই গাজর। গাজার মধ্যে পাওয়া যায় বিটা ক্যারোটিন ভিটামিন ই, ভিটামিন কে, ভিটামিন সি, পটাশিয়াম, ফাইবার, ক্যালসিয়াম আর আয়রনের মত জরুরী জিনিস। এর পাশাপাশি এই যে থাকে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন গাজর রান্না করে খাওয়ার তুলনায় কাঁচা গাজার খাওয়া অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর। গাজর চোখের জন্য ভালো গাজরে থাকা ভিটামিন এ চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সহায়তা করে। গাজরে আছে বিটা ক্যারোটিন যা শরীরের ভেতরে গিয়ে ভিটামিন ই তে পরিণত হয় যা আমাদের চোখের জন্য খুবই উপকারী।
তবে আপনি কি জানেন এই তীব্র রোদ থেকে বিটা ক্যারোটিন আমাদের চোখকে রক্ষা করে। ত্বক উজ্জ্বল করে প্রতিদিন গাজরের রস খেলে আমাদের ত্বক উজ্জ্বল হবে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞগণ। কারণ হিসেবে জানাচ্ছেন যে এটি আমাদের শরীর থেকে দূষিত পদার্থ বের করতে সাহায্য করে। কেউ যদি ব্রণ বা একনিয়ার সমস্যায় ভোগে তাদের জন্য খুবই উপকারী গাজরের রস।
গাজর ক্যান্সারে আশঙ্কা কমায় যেমন কোলন ক্যান্সার, পাকস্থলীর ক্যান্সার ,বেস্ট ক্যান্সার ফুসফুসের ক্যান্সার হাত থেকেও আমাদের রক্ষা করতে পারে। এর মধ্যে থাকে এন্টি এক্সিডেন্ট যার শরীরের ক্ষতিকর ট্রিট ডেডিক্যালসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। গাজর হার্টের জন্য খুবই ভালো এটি হার্টের অনেক উপকারী বলে মনে করা হয়।
কারণ এতে আছে একটি এক্সিডেন্ট যা আমাদের হার্টের জন্য খুবই লাভজনক। গাজরে থাকা পটাশিয়াম আমাদের শরীরের ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। গাজরে থাকা ফাইবার আমাদের ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। লাল গাজরে থাকে লাইকোপিন এটিও আমাদের হার্টকে ভালো রাখে।
গাজর খাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
আপনারা অবশ্যই জানেন অন্তত কার্যকরী ও উপকারী জিনিস যদি সঠিক সময় সঠিক নিয়মে খাওয়া না যায় তাহলে সেটি শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই সঠিক পরিমাণ ও সঠিক সময় না জেনে মাত্র অতিরিক্ত গাজর খেলে মানুষের শরীরে মাত্রা অতিরিক্ত বিটা ক্যারোটিন জমলে তা ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। গাজর মাত্র অতিরিক্ত খেলে বদহজম, গ্যাস, অম্বল কিংবা ডায়রিয়ার সমস্যা হতে পারে।
মাত্রা অতিরিক্ত গাজর রক্তের চাপ বাড়িয়ে দিতে পারে। গরমে অতিরিক্ত গাজর খেলে অনিদ্রার সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে। কোন খাবারের সাথে সামঞ্জস্য না রেখে অতিরিক্ত মাত্রায় গাজর খেলে হাত-পা মুখ ও শরীরের বিভিন্ন অংশের রং জন্ডিস আক্রান্ত রোগীর মত হলুদ হয়ে যেতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে গাজর খেলে এলার্জি সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাদের জন্য খুব সতর্কভাবে খাদ্য তালিকায় গাজর ব্যবহার করতে হবে।
গাজরের প্রধানত কি পাওয়া যায়
গাজর এমন একটি উপাদান যা পুষ্টিগুণে ভরপুর। গাজরে প্রধানত গ্লুকোজ পাওয়া যায়। গ্লুকোজ আমাদের শরীরে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। বিশেষ করে গরমে আমাদের শরীরে পানির ঘাটতি দেখা যায় তাই প্রতিদিন গাজর খাওয়ার মাধ্যমে আমরা পানির ঘাটতি পূরণ করতে পারি। শরীরের দুর্বলতা কাটিয়ে সুস্থ সবল জীবন যাপন করতে গাজলের ভূমিকা অতুলনীয়।
গাজরের মধ্যে থাকা পুষ্টি উপাদান
গাজর এমন একটি সবজি যারা সারা বছর বাজারে পাওয়া যায়। সালাত তরকারি পুডিং হালুয়া ও জুস হিসেবে খাওয়া যায় গাজর। বিজ্ঞানীরা বলেন স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী এই গাজর। গাজরে আছে ভিটামিন এ ভিটামিন বি সিক্স ভিটামিন কে এবং বায়োটিন।
এর মধ্যে আলফা ক্যারোটিন ও বিটা ক্যারোটিন থাকার কারণে এটি ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। আমাদের কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতেও অনেক সহায়তা করে। গাজরের মধ্যে আছে ভিটামিন কে এবং ক্যালসিয়াম যা আমাদের দাঁত এবং হাড়কে মজবুত করতে সহায়তা করে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন গাজর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে অনেক বেশি কার্যকর। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের গাজর খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। গাজর ছাড়া ফাইবার ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এর পাশাপাশি এর মধ্যে থাকা ভিটামিন এ এবং বিটা ক্যারোটিন ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমিয়ে দেয়।
তাই নিজের ডায়াবেটিস কে কন্ট্রোল করতে অবশ্যই নিয়মিত গাজর খাবেন। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে কাজ করে গাজর। গাজরে আছে ভিটামিন সি যা আমাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরিতে সাহায্য করে। আন্টি বডি আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
গাজরের মধ্যে কোন ভিটামিন বেশি থাকে
গুণে ভরা গাজরের উপকার ও ভিটামিনের শেষ নেই। গাজরের মধ্যে অনেক ধরনের ভিটামিন রয়েছে। গাজরের মধ্যে রয়েছে গ্লুকোজ বিটা ক্যারোটিন ভিটামিন এ ভিটামিন সি ভিটামিন বি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আয়রন ও বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন যা আমাদের শরীরের জন্য অনেক উপকারী।
গাজরের মধ্যে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এমন একটি পদার্থ যা আমাদের শরীরে অন্যান্য চাপ গুলোর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ফ্রী রেডিক্যাল অস্থির অনু দ্বারা সৃষ্ট কোষগুলিতে ক্ষয় ক্ষতি প্রতিরোধ করতে পারে। গাজরে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আমাদের শরীরে অতিরিক্ত ফ্রি রেডিক্যাল বের করে দিয়ে আমাদের শরীরে কোষ গুলোকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
গাজরের মধ্যে কোন অ্যাসিড থাকে
গাজর শীতকালীন সবজি হলেও গাজর এখন সারা বছরই পাওয়া যায়। গাজরে থাকে ফলিক এসিড যা আমাদের থ্যালাসেমিয়া অ্যানিমিয়া মত রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। ফলিক এসিড সঠিক সময়ের পূর্বেই রক্তের কোষগুলো ভেঙে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। গাজরে রয়েছে অনেক ভিটামিনের মধ্যে ভিটামিন বি ৫ যাকে প্যান্টোথেনিক এসিড ও বলা হয়। এটা একটি পানি দ্রবণীয় ভিটামিন এবং শরীরের জন্য একটি অপরিহার্য পুষ্টি। যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
দৃষ্টি শক্তি বাড়াতে গাজরের উপকারিতা
গাজরের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ। আর ভিটামিন এ আমাদের চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে ও রাতকানা রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। রাতকানা মানেই অল্প আলোতে কিছু দেখতে পায় না। বাংলাদেশের অনেকেই এই রাতকানা রোগের কারণে অন্ধ হয়ে যায়। রাতকানা একটি প্রতিরোধ যোগ্য রোগ যা ভিটামিন এ খাওয়ানোর মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে ভালো হয়ে যায়।
আবার বয়সের সাথে সম্পর্কিত ম্যাকুলার অবক্ষয় (এএমডি) একটি চোখের রোগ যা বয়স বৃদ্ধির সাথে হয়ে থাকে যা আপনার পড়া, চিত্রাংকন এসব কাজগুলোর জন্য আপনার প্রয়োজন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা করতে পারে। এটি সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। এই রোগ প্রতিরোধে ভিটামিন এ একটি কার্যকর ভূমিকা পালন করে। গাজরে থাকা ভিটামিন এ আমাদের দৃষ্টিশক্তি ও বয়স জনিত অন্ধত্ব রোধে সহায়তা করে।
কাঁচা গাজর খেলে কি হয়
আমাদের শরীরে অনেক ধরনের ফ্রি রেডিক্যাল আছে যা আমাদের শরীরের কোষগুলো ধ্বংস করে দেয় কাঁচা গাজার। এটা ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের মতে শরীরে যদি ফ্রি রেডিক্যাল যদি বেশি থাকে তাহলে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে। সুতরাং ৬১ গ্রামের একটি মিডিয়াম আকারের গাজরে আছে ৫০৯ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন এ।
তাহলে দেখুন ২০১৫- ২০২০ সালের গবেষণা অনুযায়ী একজন মহিলার দৈনিক ৭০০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন এ প্রয়োজন। একজন পুরুষের ৯০০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিনের প্রয়োজন। আবার কাঁচা গাজরে রয়েছে ক্যারটিন অয়েল যা আমাদের পোস্টেড ক্যান্সার বা জরায়ু ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। একটি কাঁচা গাজর আমাদের শরীরের অনেক জটিল রোগ প্রতিরোধের সহায়তা করে।
গাজর খাওয়ার সঠিক নিয়ম
প্রতিটি খাবার খাওয়ার একটি সঠিক নিয়ম রয়েছে। গাজরের ক্ষেত্রে ও ব্যতিক্রম কিছু নয়। গাজর কাঁচা অথবা রান্না যেকোনো ভাবেই খেতে পারেন তবে বিশেষজ্ঞ গনের মতে কাঁচা গাজরের ভিটামিন বেশি। গাজরের সঠিক গুনাগুণ পেতে হলে প্রতিদিন আমাদের একটি করে মাঝারি আকারের গাজর খেতে হবে।
তবে অবশ্যই আমরা গাজরকে খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করে খাবেন। আমরা প্রতিদিন সকালে গাজরের জুসও খেতে পারি। কারণ গাজরের জুস এ পুষ্টিগুণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি থাকে। আবার কাঁচা গাজর ও খেতে পারি।
আমরা যদি গাজর রান্না করে খাই তাহলে গাজর বেশিক্ষণ রান্না করা উচিত নয়। বেশিক্ষণ রান্না করলে গাজরের পুষ্টিগুণের মাত্রা কমে যাবে। গাজর দিয়ে তৈরি রান্না করা খাবার আমাদের ঠান্ডা করে খাওয়া উচিত।
সঠিক পরিমাণে গাজর খেলে আমাদের শরীরে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আসে। গাজর প্রতিদিন খেলে যৌন শক্তি বৃদ্ধি হয়। গাজর খাওয়ার মাধ্যমে নেশার আসক্তি কমে যায়। তাই আমাদের সুস্থ থাকতে হলে অবশ্যই প্রতিদিন একটি করে গাজর খাওয়া উচিত।
আমাদের শেষ কথা
গাজর সাধারণত একটি স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এটি অনেক স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান করে থাকে। তবে কিছু ক্ষেত্রে গাজর না খাওয়াই ভালো। যদি আপনার হজমের সমস্যা থাকে তাহলে অতিরিক্ত গাজর খেলে আপনার হজমের সমস্যা আরো বৃদ্ধি করে দিবে। আপনার শরীর যদি অতিরিক্ত মাত্রায় ডায়াবেটিস থাকে এবং আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা নিবিড়ভাবে নিরক্ষন করতে হয়।
তাহলে আপনাকে গাজর খাওয়ার মাত্রা সীমিত করতে হবে কারণ এতে অনেক পরিমাণে প্রাকৃতিক শর্করা রয়েছে যা আপনার রক্তের শর্করার মাত্রাকে প্রভাবিত করতে পারে। আপনার ডায়েটে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন করতে হলে স্বাস্থ্য সেবক আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন